আর কত লাশে কঠোর হবে প্রশাসন?

হাবিবুর রহমান বাদল
নারায়ণগঞ্জে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের মতে গত ৬৬ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা ৮৯ জনে দাঁড়ালেও জেলার বিভিন্ন স্থানে করোনা উপসর্গে আরো অনেকের মৃত্যু ঘটেছে যার হিসাব স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে নেই। গতকাল সোমবার দিন ভর শহর ঘুরে মনে হয়নি নারায়ণগঞ্জ শহরে করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাব আছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করছে পুলিশ। বিনা প্রয়োজনে বাইরে ঘোরাফেরা না করার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানিয়ে মাইকিং করছে। কোথাও কোথাও প্রয়োজনে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে প্রচারণা চালাচ্ছে পুলিশ। করোন বিরোধী বিভিন্ন পরামর্শ এবং সরকারের নির্দেশনা সম্পর্কেও জনসাধারণকে সচেতন করছেও। তারপরও জনগণ পুলিশের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে আনুষ্ঠানিকভাবে নারায়ণগঞ্জ লকডাউন ঘোষণা করা হলেও এরই মধ্যে গার্মেন্ট এবং গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্তের পর থেকে জেলায় জনসমাগম বাড়তে শুরু করেছে। সরেজমিনে শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ফুটপাতে হকার বসতে শুরু করেছে। শহরের সর্বত্র শত শত মানুষের ভীড়ে যানবাহনের সংখ্যাধিক্য সেই সাথে সিংহভাগ মানুষকে কোন প্রকার স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে দেখা যায়নি। নারায়ণগঞ্জে মাত্র ৬৬ দিন আগেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোন মৃত্যু ছিল না। আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ জন। সেখানে ৬৬ দিনের ব্যবধানে গতকাল ৮ জুন সোমবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৮৯ জন মৃত্যুবরণ করেছে বলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ নিশ্চিত করেছেন। একই সংগে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫শ’ ৯৪ জনে। যদিও নারায়ণগঞ্জে করোনার নমুনা পরীক্ষা দেশের অন্যান্য এলাকার মত একই অবস্থা। এরই মধ্যে গত ৬৬ দিনে লকডাউনের নামে সাধারণ ছুটি ভোগ করে সাধারণ মানুষ একের পর এক আক্রান্ত হয়েছে। আসলে নারায়ণগঞ্জে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা কত তা সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছেনা কারণ সে পরিমাণ নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না। তবে নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ অবস্থা প্রথম থেকেই ছিল বলে নারায়ণগঞ্জকে শুরুতেই হটস্পট হিসাবে ঘোষনা করা হয়। এখন যে তিনটি এলাকায় লকডাউন দেয়া হয়েছে সেখানেও ঢিলেঢালা ভাব। যদিও জেলা প্রশাসক বলে ছিলেন আর লকডাউন নয়, এবার কঠোরভাবে সবাইকে ঘরে রাখা হবে। যার লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। লকডাউন নারায়ণগঞ্জে কার্যকর হবে না একথা প্রথম থেকেই বলে আসছি। শুধু তাই নয়, ৬৬দিন আগে যখন নারায়ণগঞ্জে করোনা ভাইরাস ভয়াবহ রূপ নিতে থাকে তখন সাংসদ শামীম ওসমান ঢিলেঢালা লকডাউনের বদলে কঠোর লকডাউন দাবি করে নারায়ণগঞ্জবাসীকে ঘরে থাকার জন্য হাতজোর করে অনুনয় বিনিনয় করেন। মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী একই দিন লকডাউন না দিয়ে কারফিউ দেয়ার দাবি জানান। সেদিন কঠোর ভাবে মানুষকে যদি ঘরে রাখা যেত আর গার্মেন্টস শ্রমিকদের এভাবে আনা নেয়া না করতো তবে মাত্র ৬৬ দিনের ব্যবধানে ৮৯ জনের মৃত্যু আমাদের হয়তো গুনতে হতো না। কারণ লকডাউন করার কয়েকটি পরিকল্পনা থাকা উচিৎ বলে মনে করেন জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ। তিনি জানান, লকডাউন করার আগে তিনটি প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। এক, লকডাউন করতে হলে কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে তার পূর্বপরিকল্পনা থাকতে হবে। দুই, যে এলাকায় লকডাউন করা হবে ঐ এলাকার জনগণকে ৪৮ ঘণ্টা আগে জানাতে হবে। যাতে তারা জরুরি কেনাকাটা সারতে পারে। তিন, কমিউনিটিকে সংযুক্ত করতে হবে। এভাবে লকডাউন কার্যকর করে লন্ডনসহ ইউরোপের অনেক দেশ সফলতা পেয়েছে। তাই লকডাউন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে উল্লিখিত তিনটি বিষয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। যাতে যেসব এলাকায় লকডাউন দেয়া হবে সেসব এলাকার লোকজন যাতে তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী যথা সময়ে পাওয়াসহ সঠিক চিকিৎসা পান সে ব্যবস্থা করতে হবে। মোটকথা করোনা ভাইরাস মোকাবিলার ক্ষেত্রে রয়েছে সমন্বয়ের বড়ো ঘাটতি। এ কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা করোনা রোগীর পাশে যান না। তারা মাস্ক ও পিপিইর মান নি¤œমানের কারণে ভয়ে আছেন। অনেক ডাক্তারও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যদিও নারায়ণগঞ্জে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্য কর্মীদের থাকা খাওয়াসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ইতিমধ্যে করা হয়েছে। তারপরও সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছেন না এমন অভিযোগ অহরহ শুনা যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ২ এপ্রিল করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা রোধে সকল শ্রেনী পেশার লোকদের নিয়ে বৈঠকে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন ও সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ সেদিন জানান, জেলায় মাত্র ৩ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে। যদিও এর আগে ৮ মার্চ দেশে প্রথম যে তিনজন করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা হয়, তাদের দুইজন ছিল নারায়ণগঞ্জের। কিন্তু এরপরও নারায়ণগঞ্জের স্বাস্থ্য বিভাগ কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। যদিও ২৮ দিন পর আক্রান্তের সংখ্যা তেমন না বাড়লেও বিদেশ ফেরতদের চিহিৃত করে তাদেরকে কোয়ারাইন্টেনে নিতে পারেনি প্রশাসন। ২ এপ্রিল প্রশাসন তিনজন আক্রান্তের কথা বললেও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আসা যাওয়ায় এবং সিথিল লকডাউনের কারণে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ মে দাঁড়ায় ১১শ ৬২ জনে। আর ইতিমধ্যে আমাদের মাঝ থেকে না ফেরার দেশে চলে যান ৫২ জন। এরই মধ্যে দোকানপাট খুলে দেয়াসহ সবকিছু অঘোষিত ভাবে স্বাভাবিক হয়ে আসলে নারায়ণগঞ্জ এখন যেন অনেকটাই মৃত্যুপুরী। গতকাল সোমবার ৮ জুন জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের মতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৫শ’ ৯৪ জনে দাড়িঁয়েছে। আর মৃত্যু ঘটেছে ৮৯ জনের। এই তালিকা জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে জানা যায়। লকডাউনে মেয়রের তেমন কোন ভ’মিকা না থাকায় এবং কাউন্সিলরদের দুই একজন ছাড়া অধিকাংশই ঘরে অবস্থান করায় এবং ক্ষমতাসীন দলের পদ পদবীধারীরাও এখন অনেকটাই আত্মগোপনে বলা চলে। এনিয়ে সাধারণ মানুষের মনে বার বার প্রশ্ন উঠছে জেলা প্রশাসক বার বার কঠোর হওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ন ভিন্ন। তাই নারায়ণগঞ্জের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে লকডাউন নয় সাধারণ মানুষ বুঝে এমন শব্দ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে রেডজোন এলাকা থেকে কোন অবস্থাতেই বাড়ির বের হতে দেয়া যাবে না। তবে পাশাপাশি তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব সামগ্রী প্রয়োজন তা জোগান দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত। অন্যথায় নারায়ণগঞ্জে মৃত্যুর মিছিল আরো বাড়বে।
Leave a Reply