তমিজ ভাই হারেননি হেরেছে সুবিধাভোগী

হাবিবুর রহমান বাদল
একজন নির্লভ, সদালাপী, সর্বজন প্রিয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তমিজ উদ্দিন রিজভী চলে গেলেন। গতকাল মঙ্গলবার বাদ যোহর ডিআইটি মসজিদে নামাজে জানাযা শেষে তমিজ উদ্দিন রিজভীকে পাইকপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। মরহুম তমিজ উদ্দিন রিজভী’র নামাজে জানাযা হাজারো লোকের উপস্থিতি তার বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্ককে যেন জানান দেয়। আজকে বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা করছে আওয়ামীলীগ। এ আওয়ামীলীগের ক্ষমতায় আসা খুব একটা নিষ্কন্টক ছিলনা। ৭৫’র পরবর্তী সময়ে আওয়ামীলীগের অনেকেই নিজেকে দলীয় পরিচয় না দিয়ে রাজনীতি করি না এমন মন্তব্য করতো। বিএনপি, জামাতের শাসন আমলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একদল নির্লভ, সাংস্কৃতিক সেবী ও বুদ্ধিজীবিসহ কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা মিলে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তখনও লালায়িত ছিলনা। অবশ্য এ কথা না বললেই নয় বর্তমান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আর শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিকে এক করে দেখা ঠিক হবেনা। সেই সময়ে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামীলীগ কিংবা তাদের সমমনারা অথবা এখন যারা আওয়ামীলীগের নামটি ব্যবহার করে টোকাই থেকে কোটিপতি হয়েছে তাদের কাউকে সেই সময়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঠিক ঐ সময় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে আমরা কয়েকজন মিলেঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নারায়ণগঞ্জ শাখা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সে মোতাবেক প্রয়াত গিয়াসউদ্দীন বীর প্রতিক কে আহ্বায়ক এবং তমিজউদ্দিন রিজভী কে সদস্য সচিব করে আমরা নারায়ণগঞ্জ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করি। সেই সময়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশ এমনকি কখনো কখনো মশাল মিছিল করার জন্য মশালের তেল কেনার পয়সাও থাকতো না। আওয়ামীলীগের সুবিধাবাদীদের কাছে ধরনা দিয়েও কোন প্রকার আর্থিক কিংবা অন্য কোন সহযোগিতা পায়নি। এখানে বাসদের সেই সময়কার কতিপয় নেতাকর্মীকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি একারণে বিভিন্ন স্থানে পোষ্টার লাগানো থেকে শুরু করে প্রচার-প্রচারণায় তাদেরকে যেখানেই কাজে লাগিয়েছি তারা সেই দায়িত্ব সুচারু রুপে পালন করেছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে নারায়ণগঞ্জ আনলে সেই সময়কার বিএনপি নেতারা পুলিশের সহায়তায় আমাদের উপর হামলা চালায়। পুলিশ শত শত টিআর গ্যাস ছুড়লে ক্যান্সার আক্রান্ত শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে উকিলপাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদে ঠাই দিতে পারিনি। শত শত টিআর গ্যাস আর রাবার বুলেটের মধ্যে জাহানারা ইমামকে রক্ষা করতে গিয়ে সেদিন যারা আহত হয়েছিল তারা আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর এক মুহুর্তের জন্য আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে প্রবেশ কিংবা নিজেকে আওয়ামীলীগের একজন সুহৃদ হিসাবে পরিচয় দিয়েছে এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। অনেক কষ্টে অসুস্থ্য জাহানারা ইমামকে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে নিয়ে তাকে রক্ষা করি। এককথায় বলা চলে সেই সময়গুলি শত প্রতিকূলতার মধ্যে আমরা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচারে চেষ্টা করেছি। সাধারণ মানুষের মধ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সহ সৈরাচারীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি। সেই সময়ে যে মানুষটা সকল প্রকার কাজ কর্ম ফেলে এই দায়িত্বটি পালন করতে ছুটে বেড়িয়েছে সেই তমিজ উদ্দিন রিজভী কখন কিভাবে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি থেকে বাদ পড়ে গেল আমরা কেউ তা জানলাম না। দূর থেকে দেখলাম হঠাৎ করে আওয়ামীলীগের সুবিধাভোগী কিছু লোক ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নারায়ণগঞ্জ কমিটি গঠন করে বিভিন্ন জায়গায় নেতার আসন অলংকৃত করেছে। অথচ দুঃখ জনক হলেও সত্য যে যারা দুঃসময়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি করে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় বসাতে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে তাদেরকে বাদ দেওয়ার আগে বর্তমানের সুবিধাভোগীরা একবারও সৌজন্যবশত: নতুন কমিটি গঠনের কথা বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। যে দুঃখটা আজীবন তমিজ উদ্দিন রিজভী মনে মনে পোষন করে গেলেও মুখ খুলে কাউকে বলেনি। একই দুঃখ নিয়ে গিয়াস উদ্দীন বীর প্রতিকও না ফেরার দেশে চলে গেছে। একদিন আমরাও পঙ্কিলময় পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিব এটাই সত্য। আমার ধারণা ছিল তমিজ উদ্দিন রিজভীর জানাযায় মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের ঢল নামতে পারে সেই বিশ্বা সঠিক হয়নি। বলার মত ক্ষমতাসীন দলের কাউকে জানাযায় আমি দেখিনি। শুধু তাইনয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে ব্যবহার করে চলেছে এমন অনেকেই এই বীর মুক্তিযোদ্ধার জানাযার নামাজে দেখা যায়নি। তমিজ উদ্দিন রিজভী প্রকাশ্যে রাজনীতি করেননি তবে কাছ থেকে তাকে যতটুকু দেখেছি তাতে আমি শতভাগ নিশ্চিত তিনি ক্ষমতাসীন দলের একজন অন্ধভক্ত ছিল। যেকারণে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে জীবনের ঝুকি নিলেও তার সাথে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়া আরেকটি নতুন কমিটি আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর করায় তিনি শুধু দুঃখই পেয়েছেন মুখ খুলে কিছু বলেননি। অসুস্থ্য অবস্থায় নিয়মিত নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে আসাটাই ছিল তার শেষ ভরসা স্থল। নারায়ণগঞ্জে কোন প্রকার আন্দোলন সংগ্রাম না করেও ক্ষমতাসীনদলের কতিপয় নেতা যেভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে তা লিখতে আমার নিজের কাছেও লজ্জা লাগছে। তমিজ উদ্দিন রিজভীকে যারা অপমান করেছে একদিন ইতিহাসের কাছে তাদেরই অপমানিত হতে হবে। তবে শেষ বারেরমত তমিজ ভাইকে বলবো ক্ষমতা আর অর্থের লোভে অন্ধ সেই সব সুবিধাভোগীরা আপনাকে অপমান করেনি বরং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ওরা অপমান করেছে। এ সত্য যত ভাবেই অস্বীকার করবে এইসব সুবিধাভোগীরা নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে আস্থাকুড়ে একদিন নিক্ষিপ্ত হবে এটা আগামী দিনের ইতিহাসেই প্রমানিত হবে। তমিজ উদ্দিন রিজভীর এই আন্দোলন সংগ্রাম বৃথা যায়নি বলেই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আজ একযুগ ধরে ক্ষমতায় আছে। গতকাল মঙ্গলবার তমিজ ভাইয়ের জানাজায় হাজারো মানুষের উপস্থিতি থাকলেও সুবিধাভোগীরা না থাকায় কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করলেও আমি বলব তমিজ ভাই আপনার যোগ্য সন্মান সাধারণ মানুষ দিয়েছে। আপনি হারেননি- হেরেছে সেইসব সুবিধাভোগীরা। যারা নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে আজীবন সুবিধাভোগী হিসাবেই চিহিৃত হয়ে থাকবে।
Leave a Reply