নাসিকে মশায় ডুবাবে নৌকা!

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট
শহরের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে ভর্তি অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে যায় ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নিলয়। ভিতরে ডাক্তার থাকায় কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয় তাঁকে। বারান্দায় দাঁড়াতেই ২০-২৫ সেকেন্ডের মধ্যে মশা ঝেঁকে ধরে তাকে। অতিষ্ঠ হয়ে তিন-চারবার জায়গা পরিবর্তন করলেও একই অবস্থা। মশা থেকে কিছুতেই রক্ষা মিলছে না। অবশেষে বাধ্য হয়ে বন্ধুকে না দেখেই মশার যন্ত্রনায় অতিষ্ট হয়ে পালাতে হয়েছে তাকে। এভাবেই সিটি এলাকায় মশার যন্ত্রনার কথা বর্ননা করলেন নিলয়। একই ধরনের যন্ত্রণার কথা জানালেন ২৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা জান্নাতুল ফেরদাউস। তিনি বলেন, রাতের বেলা মশা মারি, দিনের বেলা ঘুমাই। শুধু এ দুটি ওয়ার্ড নয়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডেই এই চিত্র নিত্যদিনের। স্থানীয়রা জানান, জলাশয়, রাস্তার পাশের নালা ও যত্রতত্র পড়ে থাকা ময়লা পরিষ্কার না করায় আশংকাজনক হারে বেড়েছে মশার উপদ্রব। সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডের প্রায় ২৫টি এলাকা ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ এলাকাতেই গত এক বছরে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেননি স্থানীয়রা। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে অনেকে দিনের বেলায় মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হয় সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলে, নয়তো বন্ধ করে রাখতে হয় ঘরের দরজা জানালা। ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানে মেয়র ও কাউন্সিলরদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, মশা নিধনসহ জনগণের দুর্ভোগ লাঘব করে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। মশা আপনার ভোট যেন খেয়ে না ফেলে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। চৌধুরী বাড়ি এলাকার বাসিন্দা আল-আমিন বলেন, ‘সন্ধা নামলেই মশার যন্ত্রণায় ঠিকমতো কোথাও বসা যায় না। সারাক্ষণ কানের কাছে ভনভন করতে থাকে। আমরা সিটি করপোরেশনের কোনো সুবিধাই পাচ্ছি না। ঠিকমতো মশার ওষুধ ছিটালে এ সমস্যা হতো না।’ এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৩টি অঞ্চলের ৭ জন কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এর মধ্যে সব কাউন্সিলর মশক নিধনের দায় চাপিয়েছেন সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের ওপর। তাঁরা বলছেন, এ বিষয়ে জানানো হলে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যায়। ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি বলেন, আমার ওয়ার্ডে প্রতিদিন ভোরেই ৫ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী মশার লাভা নষ্ট করতে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এলাকার মানুষের জন্য ব্যক্তিগত টাকা দিয়ে আমি নিজেই ফগার মেশিন কিনেছি। কিন্তু তারপরেও মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আমার নিজের ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখি। ভিতরে একবার ওষুধ ছিটালেও মশার যন্ত্রণায় সেই রাতে আবার ওষুধ ছিটানো হয়। ১৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে আমাদের যে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। সেগুলো প্রতিদিনই স্প্রে করছি। কিন্তু মশা না মরে উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। বাতাসের মধ্যেও মশা কামর দেয়। মিটিংয়ে প্রায়ই ব্যাপার গুলো বলি, এখন ওষুধের ভিতরে কি আছে? সেটা আমরা বলতে পারি না।’ ১৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিউদ্দিন প্রধান বলেন, ‘মেয়রকে তো পায় না, মশার কারণে তাই আমাদেরকেই মানুষ গালমন্দ করে। মানুষের কাছে জবাবদিহীতা করতে হয় আমাদের। আমরা মশা নিধনে কার্যকরী ভূমিকা রাখার অনুরোধ মেয়রকে জানিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। আসলে বলার, কিছু নাইরে ভাই। মশার জ¦ালায় অতিষ্ঠ হওয়ার কথা স্বীকার করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. আলমগীর হিরণ বলেন, শহরের তুলনায় সিদ্ধিরগঞ্জে মশার উপদ্রব বেশি। আমি নিজে ওই দিন ছিলাম। পারলে, আমাকে আলগাইয়া নিয়ে জায়গা। মশা নিধন করতে আমাদের ৫ জন করে কর্মী প্রতিদিন প্রতি ওয়ার্ডে হেন্ড স্প্রে করা হয়। রাতে ৩টি করে ওয়ার্ডে ফগার মিশিনের মাধ্যমে মশা নিধন করা হয়। আশা করছি, রোববার থেকে এই কার্যক্রম আরও বাড়বে। এদিকে, গত ১ বছরেও ‘মশক নিধন’ দেখিনি জানিয়ে ৯নং ওয়ার্ডের নাইন্তাপাড়া এলাকার বাসিন্দা নাদিম আহমেদ বলেন, ‘পুরো জালকুড়িতেও কেউ দেখেনি। কাউন্সিলরের দৃষ্টি আকর্শন করে ‘মশা নিধনে ব্যবস্থা নেওয়া’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোন প্রদক্ষেপ নেইনি। এবার মেয়র ভোট চাইতে আসুক, আমরাও দিয়ে দিবো’। এ নিয়ে কথা বলতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুল আমিনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য যে, সিটি করপোরেশনে বছর বছর মশা নিধনে বরাদ্দ বাড়লেও মশক নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি নেই। ২০২০/২১ অর্থবছরের বাজেটে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে সরকারি ও নিজস্ব অর্থায়নে ১ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা মশন নিধন ঔষধ ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে বলে সিটি কর্পোরেশন থেকে বলা হলেও কোন কাজ হয়নি। গত বছরের ১২ মার্চ প্রধাণমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠানে অপরিচ্ছন্নতা ও নগরের মশা নিধনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে নারায়ণগঞ্জের তিন সংসদ সদস্য তাদের বক্তব্যে এনসিসি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘পরিচ্ছন্ন গ্রাম-পরিচ্ছন্ন শহর’ কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ওই কর্মসূচি শুরুর আগে নারয়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সুধী সভায় এনসিসি মেয়রের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন নারায়ণগঞ্জের ওই তিন সংসদ সদস্য।
Leave a Reply