বিস্ফোরনে বিপ্লবের সংসার তছনছ

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট
‘গরিবের এমন দুর্ঘটনায় পড়ার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। শাশুড়ি মরে বেঁচে গেলেন। আর যারা থেকে যাবেন তারা কে কীভাবে বাঁচবেন? কে সুস্থ হবেন আর কে পঙ্গু হয়ে থাকবেন, আল্লাহই জানেন!’ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার একটি বাসায় গ্যাসের চুলার পাইপলাইন বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ড যে সর্বনাশ ঘটিয়েছে, তা এভাবেই বলতে বলতে কাঁদছিলেন বিপ্লব হোসেন। ওই বাসায় ছিল বিপ্লবের শ্বশুর হাবিবুর রহমানের সংসার। গত ২৩ এপ্রিল সেখানে গ্যাসের পাইপলাইন থেকে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটলে দগ্ধ হন বিপ্লবের স্ত্রী ও দুই মাসের পুত্রসন্তান মিহির, শ্বশুর হাবিবুর রহমান, শাশুড়ি আলেয়া বেগম, আলেয়ার বৃদ্ধা মা, নবম শ্রেণি পড়ুয়া শ্যালক। এ ঘটনায় আরেকটি বাসার পাঁচজনও দগ্ধ হন। এদের মধ্যে বিপ্লবের ছয় স্বজনকে ওই দিন ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। বাকিদের কয়েকজনকে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। বিপ্লবের শাশুড়ি আলেয়া বেগম বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার শরীরের ৮০ শতাংশের বেশি অংশ দগ্ধ ছিল। গত ২৫ এপ্রিল রাতে মারা যান তিনি। অন্যদিকে হাবিবুর রহমান ও তার বৃদ্ধা শাশুড়ির (আলেয়ার মা) পুড়েছে প্রায় অর্ধেক শরীর। তবে অবস্থার কিছুটা উন্নতির কারণে তাদের আইসিইউ থেকে পোস্ট আপারেটিভ ওয়ার্ডে নেয়া হয়েছে। বাকিরা রয়েছেন সাধারণ ওয়ার্ডে। আর এসব মানুষকে দেখভাল করার জন্য অবশিষ্ট দুজন, বিপ্লব ও তার বড় শ্যালিকা। কখনো এ দুজন ছুটছেন আইসিইউতে, কখনো পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে, আবার কখনো সাধারণ ওয়ার্ডে। বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউয়ের সামনে কথা হচ্ছিল বিপ্লবের সঙ্গে। তিনি জানান, পরিবারটির উপার্জনক্ষম সবাই গার্মেন্টসের কর্মী ছিলেন। সেখানে ভাড়া বাসায় থাকতেন। অগ্নিকাণ্ডে তাদের সবকিছু পুড়ে গেছে। এ অবস্থায় পরিবারটি যে কতটা অসহায়ত্বের মধ্যে পড়েছে সেটা অবর্ণনীয়। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বিপ্লব বলেন, ‘সব পুড়ে গেছে ভাই। ঘর, সংসার কিছুই নেই এখন। মায়ের মতো শাশুড়ি ছিলেন, তিনিও চলে গেলেন। গার্মেন্টসে চাকরি করতেন, সংসার চালাতেন। এখন শুধু বাড়তি মানুষগুলো থেকে গেল। কীভাবে তাদের চিকিৎসা হবে? কীভাবে সংসার চলবে?’ তিনি বলেন, ‘আমি একা মানুষ। কী করছি নিজেও জানি না। রক্ত জোগাড় করতে পারছি না। ডাক্তারদের সহায়তায় ছয় ব্যাগ রক্ত জোগাড় করেছি কয়েকদিনে। শাশুড়িকে দিয়েছি, কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারলাম না। যারা আছেন তাদের কতো টেস্ট, কতো ওষুধ। কীভাবে কী করবো?’ সর্বস্ব হারানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন সুস্থ হয়েও যাবো কোথায়? আজ শ্যালককে রিলিজ (ছাড়পত্র) দেবে। ওকে কোথায় রাখবো? এমন দুরবস্থা দেখে (আত্মীয়-স্বজন) কেউ যোগাযোগও করছে না। সবাই পর হয়ে গেছে। শাশুড়ির লাশ কোথায় নেব তাও জানি না।’ কথা বলতে বলতে বিপ্লব তার পকেট থেকে কিছু টাকা ও মোবাইল ফোন বের করে দেখিয়ে বলেন, ‘দুদিন খরচের পরে জমানো ২৬ হাজার টাকার মধ্যে আট হাজার টাকা এখন আছে। আর এই একটা বাটন ফোন। এছাড়া পুরো পরিবারের গায়ের কাপড় ছাড়া কিছুই নেই।’ ‘বাড়ির মালিক, পাড়া-প্রতিবেশী কেউ একবারও যোগাযোগ করেনি। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে যখন রোগী নিয়ে ঢাকায় আসি, তখন এক পুলিশ সদস্য বলেছিলেন, কোনো সমস্যা হলে জানাতে। আজ ফোন করেছিলাম। বললেন দেখি, স্যারদের জানাই’Íআক্ষেপ ঝরে বিপ্লবের কণ্ঠে। তাহলে যারা ভর্তি আছেন, তাদের চিকিৎসার খরচ চলবে কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাব নেই বিপ্লবের কাছে। অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন, ‘আল্লাহ যাদের বাঁচাইছেন, তখন আল্লাহই ব্যবস্থা করবেন। কেউ সাহায্য করবে হয়তো। সেই আশা (সাহায্যের) ছাড়া আর কিছু নেই এখন।’ জানা যায়, দুর্ঘটনাটি ঘটে ফতুল্লা থানার তল্লা এলাকায় মডেল গার্মেন্টসের দক্ষিণ পাশে স্থানীয় মফিজুল ইসলামের তিনতলা বাড়িতে। তৃতীয় তলার ওই বাসায় বিস্ফোরণে বাড়ির ওপরের অংশ এখন বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে। বিস্ফোরণে উড়ে যায় ভবনের দেয়ালসহ আসবাবপত্র। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার দিন খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভায়। দগ্ধদের উদ্ধার করে পাঠায় হাসপাতালে। নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জানান, ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় গার্মেন্টস শ্রমিক কয়েকটি পরিবার বসবাস করতো। রাতে দগ্ধ পরিবারের লোকজন চুলার বার্নার বন্ধ না করেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাতে চুলা থেকে গ্যাস বের হয়ে রান্নাঘরসহ অন্যান্য ঘরে ছড়িয়ে জমাট হতে থাকে। ভোরে যখন রান্নার জন্য চুলা জ্বালানো হয়, তখন গ্যাসের পাইপলাইনের বিস্ফোরণ ঘটে। তবে বিপ্লবের দাবি, তার শ্বশুরের বাসার চুলা বন্ধ ছিল। লাইনে লিকেজের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও ওই এলাকায় বিভিন্ন স্থানে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর জন্য গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা দায়ী।
Leave a Reply