আজ বুধবার | ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ | ১ মাঘ ১৪৩১ | ১৪ রজব ১৪৪৬ | দুপুর ১২:৫২

জীবনের কিছু কথা

ডান্ডিবার্তা | ০৩ মার্চ, ২০২৪ | ১:৩৭ অপরাহ্ণ

ইসরাত রুবাইয়া

২০১৪ সালের কথা। জয়দেবপুর থেকে তুরাগে উঠেছি নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে।

ট্রেনে বসে আছি, দৃষ্টি দূর আকাশে। কি দারুণ  আকাশটা! মন উড়ে যেতে চাইছে আকাশ পানে।এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি।সংসার, ছেলে-মেয়ে,স্বামী কারো কথা মনের আঙ্গিনায় নেই।এই মূহুর্তে আমি পৃথিবীর সব চেয়ে সুখি মানবী। সুখ টুকু বেশিক্ষণ টিকলোনা।একটা নারী কন্ঠের শব্দে চেতনা ফিরলো আমার। “শ্যার শ্যার আজকা কিছু দিতে পারুমনা।আজকা অল্প কয়ডা জাম পাইছি।আরেক দিন দিমুনি।”

আমি অনেকক্ষন তাকিয়ে ওদের কথার ভাবভঙ্গিতে বুঝতে পারলাম মহিলা টিকেট কাটেনি।আর স্যার বলে যাকে  ডাকছে,সে টি টি হবে হয়তো। আমি কিছু না ভেবে বলে ফেলি, “কি এমন ক্ষতি হবে আমাদের বাংলাদেশের সরকারের আপনি তের টাকার টিকিট কাটেননি বলে? হয়তো আপনি গরিব টাকা নেই। কত মানুষ কত রকমের ফাঁকি দেয়।গ্যাস চুরি করে,টেক্সদেয় না ঠিক মত, জালিয়াতি করে,ব্যাংক জালিয়াতি।এত অনিয়মের পরে বাংলাদেশ সরকার  বেঁচে আছে। আপনার এ-ই তের টাকার টিকিটের জন্য বাংলাদেশ সরকার মরবেনা।”

টি টি সাহেব এই কথা শুনার পর অনেকক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নীরবে চলে গেল। ঠোঁট দুটো একবার কেঁপে ওঠেছিল।হয়তো মনে মনে আমাকে খুব বকাবকি করেছে। কিন্তুু সেটা শব্দেে প্রকাশ করেননি। টি টি সাহেব চলে যাবার পর জিঙ্গেস করলাম, “কি ব্যাপার বলুন তো!”

মহিলার উত্তর,”আরে আফা টিকেট কাডি নাই।মাজে মাজে এইডা ওইডা দিয়া মাগনা ডাহা যাইগা।গ্রামের বিতরতে কমদামে কিন্না ডাহায় নিয়া বেচি। কয়ডা টাহা অয় আফা। গরিব মানুষের কপাল।”

আমার প্রশ্ন ছিল, “কি কি বেচাকেনা করেন?”

“এই দরেন যহন যা পাই তাই। মুরগী,হাঁস,জাম, আম,পেয়ারা। ”

“ও আচ্ছা।প্রতিদিন আসেন?”

“হ”

“প্রতিদিন কি টি টি সাহেবকে এটা সেটা দিতে হয়?”

“না।যেদিন বেশি আনি সেদিন দেই।এই রবিবার দুই কেজি জাম দিছিলাম।”

“টিকিটের দাম জানেন? ”

 

“না আফা।”

“তের টাকা।আপনারর দুই কেজি জামের দাম কত?”

“একশ বিশ টেকা।”

“আপনার লাভের গুড় পিঁপড়া খায়।এরপর থেকে টিকিট কাটবেন।টি টি কে কিছু দিবেন না।আপনি সিটেও বসেননা। নিচে বসে আছেন।”

“হ আফা ঠিক কইছেন।গরিব মানুষ লেখাপড়া নাই। বুঝি কম”

“শোনেন আপনিতো কমলাপুর নামবেন?”

“হ আফা।”

“তাহলে ভাড়া আরো কম হবে।

আজ কি এনেছেন দেখি!” কাপড় সরিয়ে বড় বড় গোলাপ জাম গুলো বেড় করে আমাকে দেখালো।আমি তো দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না।জীবে  জল এসে গেল।

“আমাকে আধা কেজি দেওয়া যাবে?”

“কি কন আফা!যাইবো। আনতাজে দেই।বেশি হইবো, কম হইবো না। পাল্লাডা অনেক নিচে।”

“ঠিক আছে দিন।”

আমি টাকা দিয়ে জাম মুখে পুরলাম।কি রসালো। খেতেও সুস্বাদু,দারুণ।মহিলার দিকে তাকিয়ে জাম খাচ্ছি।

“খাবেন আপনি?”

মহিলা মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বললো, “কি কন আফা!খান আপনে।”

আমাদের দেশিফল।যার তুলনা হয় না দামও খুব কম। আপেল আগুরের চেয়ে শতগুণে ভালো।

“আফা কই যাইবেন? ”

“নারায়ণগঞ্জ। ”

“হেইডা কি আমার আগে না পরে? আপনের পোলাপান নাই একলা যে!”

“আছে।এক ছেলে,এক মেয়ে।”

“এহানে কেরে আইছেন? ” “গাজীপুর আমার বাড়ি আছে। কিছু কাজছিলো,করাতে এসেছি। আপনার বাচ্চা কয়জন?”

“দুইডা পোলা আফা।”

“স্বামী কি শ থাকি আমি।বড় বড় চোখ,পাতলা ঠোঁট, চিকন নাক।এক সময় খুব সুন্দর ছিলেন বোঝাই যাচ্ছে।  দুঃখে কষ্টে আজ বিবর্ণ। রেলগাড়ী চলছে আপন গতিতে। আমি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে।কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল সেই কথাটা,  “কি যেন খায়!”

কি খায়? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি। নিশ্চয়ই নেশাজাতীয় কিছু হবে।

ইয়াবা,ফেন্সিডিল,হেরোয়িন?না এসব নয়।এসবের দাম বেশি, সহজলভ্যও নয়।মনে হয় গাঁজা হবে।খায় আর ঘুমায়।হুম গাঁজাই হবে।হায়রে নেশা!কি যে হবে!দেশটা শেষ করে দিচ্ছে,যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে!

এতো সেদিনের কথা আমাদের পাশের বাড়ির একটা ছেলে।কি সুন্দর দেখতে।বাবার টাকা পয়সার অভাব নেই।নেশায় আসক্ত।ডিবি পুলিশ ইয়াবাসহ ধরে নিয়ে গেছে।অনেক টাকা খরচ করে ছাড়িয়ে এনেছে। ভিষণ মেরেছিল।টাকা, মানসম্মান সবই গেল।ওর মা স্ট্রোক করেছে ছেলের টেনশনে।

দীর্ঘ একটা নি:শ্বাস বেড়িয়ে আসে বুকের গহীন থেকে। আমার ছেলের হাসি ভরা মুখটা ভেসে উঠে চোখের সামনে। আমার ছেলেটা ভালো আছে তো? নাকি অসৎ সঙ্গে মিশে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে!ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন ছুটে চলে তার আপন গন্তব্যের দিকে।আর আমার মনের গহিনে কষ্টের ঘন্টা বেজে চলেছে ট্রেনের শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে বুকের ভিতরে। নিজের অজান্তে চোখ থেকে গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গরিয়ে নিচে পড়লো ।

হে আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটাকে ভালো রেখো।বুকের গহীন থেকে আরেটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।

“আফা!ও আফা!আইয়া পরছি কমলাপুর।নামবেন না?”

মহিলার কথায় আমার চেতনা ফিরে এলো।বললাম,”আমি নারায়ণগঞ্জ যাবো।আপনি তো এখানে নামবেন।”

“হ আফা।আফনের কতা আমার মনে থাকবো। বুলমু না। অনেক বালা মানুষ আপনে।” ট্রেনটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। মহিলাটি তার জিনিসপত্র নিয়ে নেমে কোমর  দোলাতে দোলাতে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল, আমি তাকিয়ে রইলাম তার অদৃশ্য পথপানে।  মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো,”হে আল্লাহ তুমি এই নারীকে ভালো রেখো।সে যেনো জীবন যুদ্ধে বিজয়ী হয়।”আমি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম  ট্রেন ছেড়ে দিলো আপন গন্তব্যের দিকে।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা