সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি
মাঝে মাঝে খুব সামান্য কোনো কাজের সাফল্যে যখন কেউ কেউ বলে ফেলেন- ‘আপনারতো অনেক সাহস’, তাদের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা ছোট্ট হাসি দেই, আর কোনো কথা বলি না। কেননা তখন মনে মনে অতিত স্মৃতিতে ফিরে যাই। এটাতো ডিজিটাল সময়, যখন কারও ধারনাও ছিল না এক সময় হাতে হাতে মোবাইল হবে, সেই মোবাইলে সিনেমা দেখা যাবে, ক্যামেরার মতো ছবিও তোলা যাবে, ভিডিও করা যাবে, ঘরে ঘরে ইন্টারনেট-কম্পিউটার থাকবে, সাংবাদিকতার মত চ্যালেঞ্জিং পেশাটিও হাতের মুঠোয় চলে আসবে, যখন সাধারন ঘরের নারীদের জন্য সর্বোচ্চ ১০ম শ্রেণীতেই বিয়ের পিড়ি নির্ধারিত ছিল। অর্থাৎ এসএসসির পর মেয়ের বিয়ে হবে- এটা যেনো সাধারন ঘরের বাবা মায়েরা মানতেই পারত না। সেই সময় একলা নারী হিসেবে এমন একটা পেশাকে বেছে নিয়েছিলাম, যেখানে শত শত পুরুষের সাথে দিনের পর দিন নিজেকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ করেছি। কাজের যুদ্ধ নয়, একজন নারী হিসেবে নিজের অস্তীত্বকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। অফিস কিংবা অফিসের বাইরে পুরো শহর জুড়ে কোথাও ছিলনা নিজের পেশার কোনো একজনও নারী সহকর্মী। এত এত পুরুষের ভীরে একমাত্র নারীকে যেনো পুরুষ মানুষগুলো কোনোভাবেই সহ্য করে নিতে পারছিল না। তাদের দেমাগে/ব্যক্তিত্বে যেনো বেশ বড়সড় আঘাত করে বসেছিলাম আমি এই পেশায় এসে। তাই আমাকে নানা ধরনের ভয় দেখিয়ে, নানা ধরনের নোংরা টিপ্পনি কেটে, আমার সম্পর্কে আজগুবি সব আজেবাজে মন্তব্য ছড়িয়ে আমাকে এই পেশা থেকে সড়িয়ে দেয়াই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। একবার এক পত্রিকা অফিসে আমার সিনিয়র এক সহকর্মী আমাকে নিউজ এসাইনমেন্টে পাঠানোর বাহানায় বাজে একটা ঘটনার জন্ম দিতে চেয়েছিল, যাতে করে ভয় পেয়ে সরে যাই তাদের পৃথিবী থেকে। না, লোকটি তার অসৎ উদ্দেশ্য সফল করতে পারেনি। তার সেই নোংরা পরিকল্পনাটি জানতে পেরে সেই পত্রিকার কাজ ছেড়ে দেই, কিন্তু পেশা ছাড়ি না। এর কিছুদিন পরেই এক মাদক ব্যবসায়ীর থেকে নিয়মিত চাঁদা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কলম বন্ধ করে রাখা এক সহকর্মী যখন আমাকে দেখল তার সেই তেলমারা লোকের কুকর্ম তুলে ধরে একের পর এক সিরিজ নিউজ করে যাচ্ছি, তখন সে এক নোংরা নাটক সাজালো। আমি কোথায় আর যাকে দিয়ে আমাকে জড়াচ্ছে সে কোথায় কে জানে তখন, অথচ পাবলিক প্লেসে কাজ করার সময় একটা কথা ছড়িয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল। সেদিন খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম অবশ্য। সেই ভয়টা ছিল শুধুই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে একজন নারী হয়ে পুরষদের সমানে সমান হয়ে কাজ করছি, অথচ এই অবস্থায় যদি কোনো পুরুষকে জড়িয়ে বাজে কথা ছড়ানো হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ জীবনে কি হবে? শুধুমাত্র মান সম্মান এর ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। কেননা মানুষতো জানবে না কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে, তারা নারীর সম্পর্কে একটা নেগেটিভ কথা শুনলেই তার সাথে ৯৯ গুণ লাগিয়ে প্রচার করে বেরাবে। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে গিয়ে বাবাকে বলেছিলাম- আর সাংবাদিকতা করব না, পুরুষ সহকর্মীগুলো খুব নোংরা মনের। সমস্ত ঘটনা শুনে বাবা সেদিন শন্তনা দেয়ার বদলে উল্টো বলেছিল- ‘সাংবাদিকতা এত সহজ না, তোমাকে এসবের মোকাবেলা করেই টিকে থাকতে হবে, পেশাটা খারাপ না, খারাপ হচ্ছে এই পেশায় থাকা গুটিকয়েক খারাপ মানুষ। সুতরাং বাঘের বাচ্চার মতো সোজা নিজের কাজে ফিরো।’ মনের সমস্ত সাহস নিয়ে আগের চেয়েও দ্বিগুন আত্মবিশ্বাসে ফের কাজ শুরু করলাম। তবুও পেশা ছাড়লাম না। কেননা ছাত্র জীবন থেকে এই একটাই লক্ষ্য আমার। তাই কারও নোংরা চিন্তা ভাবনা কিংবা কারও দেখানো ভয়ে নিজের লক্ষ্য থেকে ছিটকে পরার মানুষ আমি ছিলাম না এবং আজও নই, যার উৎকৃষ্ট প্রমান- আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশী প্রবাসী নারীদের নিরাপত্তায় করা আমার স্বীকৃত কাজগুলো। এ দেশে ক’জন সাংবাদিকের বুকের পাটায় এত সাহস যে সমস্ত লোভ লালসাকে বাদ দিয়ে তার দিকে তাঁক করে রাখা এজেন্সি মালিকদের পিস্তলের গুলিকে উপেক্ষা করে মাথা উঁচু করে নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রবাসে গিয়ে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ার মা-বোনদের দেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনতে পারে? যা আমি নিয়মিত করে যাচ্ছি মানসিক তৃপ্তি সহকারে। কই, আমাকে কটাক্ষ করা সেইসব পুরুষ নামের কালপিটগুলোকেতো দেখলাম না দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে আমার মত কোনো কাজ করতে? কথায় আছে- ধৈর্য্য, সৎ সাহস এবং ভাল কিছু করার লক্ষ্য থাকলে সেখানে সফলতা অনেক দেরিতে হলেও একদিন আসতে বাধ্য। আর এসবের জন্য লাগে সাহস(courage), সৎ সাহস(honest courage)।
হ্যা, শত কাটার মাঝেও ফুলের মতো সুন্দর মানসিকতার কয়েকজন পুরুষ সহযোদ্ধাদের পেয়েছিলাম বলেই হয়ত পথটা একেবারে কাটায় পরিপূর্ণ হলেও অন্তত টিকে থেকেছি। যারা বরাবরই আমাকে বয়স ভেদে সম্মান করেছেন, কেউ ¯স্নেহ করেছেন এবং সবাই মানসিক শক্তি দিয়েছেন। কত দুঃস্বপ্নময় ছিল সেইসব দিনগুলো..। এখনও তা ভাবলে গা শিউরে উঠে! প্রতিটা দিন পেশাগত কাজে নতুন নতুনভাবে নিজেকে দক্ষ করে তোলার চেয়ে বেশি কঠিন ছিল সেইসব নোংরা মনের মানুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান তালে এগিয়ে চলা। যেখানে প্রতিটা মুহুর্ত নারী হিসেবে আমাকে কটাক্ষ করা হতো, নিচু দেখানোর চেষ্টা করা হতো। একটা সময় নারী সহকর্মীদের দেখা পেলাম, তাও নিজ জেলা নারায়ণগঞ্জে না, ঢাকাতে ম্যাস্ লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি) তে সাংবাদিকতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একের পর এক প্রশিক্ষণ ও সেমিনারে যোগ দিতে দেশের অন্যান্য জেলা থেকে আসা নারী সহযোদ্ধাদের পেলাম। নিজেদের স্ব স্ব জেলায় নারী হিসেবে কাজ করতে যেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতে গিয়ে প্রায় সবার সমস্যাগুলোই মিলে যেতে দেখে সবাই আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম। সাহস, সাহস যে কি জিনিষ তা হাতের মুঠোয় বিশ^কে পাওয়া এই ডিজিটাল যুগ আমাকে কি শেখাবে, তা শিখে এসেছি সেই হাতে হাতে মোবাইল/ইন্টারনেট/কম্পিউটার না থাকার সময় থেকে। একটা চিরাচরিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে থেকেও বুকে অদম্য সৎ সাহস নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম বলেই আজ জাতীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা করার মত নূণ্যতম যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছি, সম্পাদনার টেবিলে বসে কাজ করছি সারাদেশের সংবাদকর্মীদের নিয়ে। বুকে অদম্য সাহস নিয়ে বেরিয়েছিলাম বলেই ক্যামেরার পেছনে কাজ করার পাশাপাশি আজ গোটা সাংবাদিক সমাজ ও গণমানুষের অধিকার আদায়ে জাতীয় পর্যায়ে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারছি।
অপরাধ জগৎ সহ বিভিন্ন পেশা থেকে আসা ‘অশিক্ষিত নামধারী’ সংবাদকর্মীদের ভীরে এখন অনেক শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত নারীরা আমাদের প্রাণের শহর নারায়ণগঞ্জে কাজ করছে। তাদের কর্মদক্ষতা দিয়ে আলোকিত করছে সাংবাদিকতা পেশাকে। রাজধানী সহ সারা দেশময় আনাচে কানাচে এই পেশায় নারীর সংখ্যা বেড়েছে তুলনামূলকভাবে। কিন্তু একলা একজন নারী হিসেবে বাপ-দাদা/মামা-চাচা/স্বামীর পরিচয়ে নয়, বরং নিজের পরিচয়ে সেই সময়ে গোটা একটা পুরুষশাসিত সমাজে সমানে সমান কর্ম দক্ষতা দিয়ে টিকে থাকতে পারার সাহস এর পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণের তালিকা কেমন তা হয়ত এদের কেউ দেখেনি। সেই সাহসে আমি সাহসী। যে সময়ে এই একই সাহসের আর কোনো ভাগিদ্বার ছিল না। সাহসের এওয়ার্ডতো দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অর্জনের থলেতে সংরক্ষিত রয়েছেই। কিন্তু নিজেদের জীবনের প্রয়োজনে জীবীকা উপার্জনের বাইরে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে সাহসী হতে পারে কয়জন? সবচেয়ে বড় সাহস হচ্ছে- মানুষ হিসেবে দেশের মানুষের প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে নিজের জীবন বাজি রেখে বিনা লাভে কিছু করতে পারা। সেই সাহসে আমি গণমানুষের দেয়া ভালবাসায় সিক্ত একজন সাহসী মানুষ।
আমি মনে করি একজন নারীর উপার্জনক্ষম হওয়ার পাশাপাশি দেশ ও দশের জন্য এমন সাহসী হয়ে উঠা প্রয়োজন। ‘আমি পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উপার্জন করছি, আমার এবং আমার পরিবারের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছি, তার মানে আমি খুব সাহসী’। না, এটিকে আমি সাহস বলব না। আমার মতে- শুধু নিজের প্রয়োজনে নিজেকে যোগ্য করে তুলার মাঝেই যেনো নারীর সাহস লুকিয়ে না থাকে। নারী যেনো সমাজ পরিবর্তনে এবং সমাজের প্রয়োজনে সাহসী ভূমিকা রাখে। যে সমাজ নারীকে তার যোগ্যতা প্রমানের অধিকার দিয়েছে, সেই সমাজের সুরক্ষায় যেনো নারীর অনবদ্য ভূমিকা থাকে। সৃষ্টিলগ্ন থেকেই কন্যা, জায়া, জননীরুপে নারী পৃথিবীকে করেছে আলোকিত। নারী জাগরনের পথিকৃত বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে যুগে যুগে কালে কালে নারীরা ঘর সংসারের বাইরে সুশিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সমাজসেবা সহ বিভিন্ন মাধ্যমে সময়ের সাথে নিজেদের যোগ্য প্রমান করেছে। যেদেশে এক সময় নারী শিক্ষার প্রচলনই ছিলনা, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, স্পিকার স্বয়ং নারী। অর্থাৎ নারী এখন তার নিজ যোগ্যতায় দেশ চালানোর মত সর্বোচ্চ ক্ষমতাও আয়ত্ব করেছে। তাই আমরা যেনো শুধুমাত্র আমাদের নিজেদের উপার্জনের মধ্যেই সাহসকে সীমাবদ্ধ না রাখি। আমরা নারীরা যেনো স্ব স্ব জায়গা থেকে দেশ ও দশের প্রয়োজনে সাহসী ভূমিকা রেখে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখি। কারণ, courage, Not everyone has the courage to change of society.
লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
হাবিবুর রহমান বাদল ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের সাথে সাথে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার দোসররা কেউবা পালিয়েছে আবার কেউ আত্মগোপনে রয়েছে। বিগত পতিত সরকারের আমলে পেশাদার সাংবাদিকরা সব কিছু দেখলেও কোন কিছুই লিখতে পারতনা। আকাঁরে ইঙ্গিতে কোন কিছু লিখলেই সেইসব সাংবাদিকের উপর খর্গ নেমে […]
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট: বিকেএমইএ‘র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, ব্যাংক ইন্টারেস্টের কারণে আমাদের ক্যাপাসিটির বাইরে অনেক কিছু চলে যাচ্ছে। আগে ছিল, পর পর ছয়টা কিস্তিতে কেউ ব্যর্থ হলে সে ঋণখেলাপি হবে। বাংলাদেশ থেকে একটি সার্কুলার দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বর থেকে ৩টা কিস্তিতে ব্যর্থ হলে ঋণখেলাপি হবে। আগামী মার্চ থেকে একটা কিস্তি ব্যর্থ হলেই ঋণখেলাপি হবে। বর্তমান […]
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট: আড়াইহাজার থানায় দায়ের করা উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি বাবুল মিয়া হত্যা মামলা নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। গত ৩ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাবুল মিয়ার মৃত্যু হলেও দুই মাস পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি নিহত হয়েছেন উল্লেখ করে ২২ আগস্ট হত্যা মামলা করেছেন দুপ্তারা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন। এই […]
প্রকাশক ও সম্পাদক
হাবিবুর রহমান বাদল
০১৯১১০১০৪৯০
hr.badal@yahoo.com
বার্তা ও বাণিজ্যক কার্যালয়
৬. সনাতন পাল লেন
(হোসিয়ারী ক্লাব ভবন, তৃতীয় তলা)
৭৬৪২১২১
dbartanews@gmail.com
রেজি: ডিএ নং-২০৯৯