টালমাটাল বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণভাবে আমাদের কিছু দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নানা দিক থেকেই একটা চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। নতুন অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মার্কিন ডলারের পাশাপাশি স্থানীয় টাকার সংকট, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা এবং খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাংক খাত—মোটাদাগে এ সবই হচ্ছে এখন দেশের আর্থিক খাতে প্রধান সমস্যা। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়েই জুলাই মাসের ১৮ তারিখে নতুন অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতিমধ্যে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই এখনো ঠিকমতো কাজ করছে না। তাই নীতি সুদহার বৃদ্ধি, ক্রলিং পেগে অটল এবং খেলাপি ঋণ কমানোর মতো পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তই আবারও আসছে নতুন অর্থবছরের প্রথম অধ্যায়ের মুদ্রানীতিতে। বিবিএসের তথ্যমতে, এখন মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ধারাবাহিকভাবে ঋণের সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। যদিও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে দেখা যায়নি। সর্বশেষ গত মে মাসে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯.৮৯ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগেকার মুদ্রানীতিগুলোর মতো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতেও সংকুলানমুখী ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। এ ক্ষেত্রে সুদহার আরো বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। বাড়ানো হতে পারে নীতি সুদহার, রেপো, রিভার্স রেপোর মতো মুদ্রানীতির মৌলিক সুদকাঠামোগুলোও। এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ কম। ব্যাংক ঋণের সুদহার এরই মধ্যে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এর পরও নীতি সুদের হার বাড়িয়ে টাকাকে আরও দামি করে তোলা হতে পারে। এতে ঋণের সুদের হার আরো বাড়বে।
মুদ্রানীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে নতুন অর্থবছরের বাজেটের বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন—১. বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে বাজেটের আকার ছোট রাখা; ২. মূল্যস্ফীতির চাপ নিরসনে বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে উেস কর কমানো; ৩. সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ানো ইত্যাদি। তথাপি বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়াতে অনেকটাই গতানুগতিক পন্থা অবলম্বন এবং ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংক খাতের ওপর অতিনির্ভরতা মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির ক্ষেত্রে এরই মধ্যে যেসব চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে এবং সামনের মাসগুলোতেও যেসব চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে, তা চিহ্নিত করা এবং তা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য কিছু পথ কী হতে পারে, তা আলোচনার দাবি রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সভায় অর্থনীতির দুটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেমন—অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ধস। অর্থনীতিতে একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোয় পর্যাপ্ত তারল্যেরও অভাব রয়েছে। এর ফলে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় মুদ্রাবাজারে আমানত ও ঋণের সুদহার অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বেশ কয়েক বছর আমানতের ঋণের সুদহার ৬-৯ শতাংশে সীমিত থাকায় আমানতের প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে শ্লথ হওয়ার বিপরীতে ব্যক্তি খাতে ঋণের চাহিদা ও প্রবৃদ্ধি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি করোনা-পরবর্তী সময়ে আমদানি ব্যয়ও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে সার্বিকভাবে দেশের লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতিও মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পায়, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধস এবং ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহে শ্লথ প্রবৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এবারের মুদ্রানীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। নতুন সুদহার স্মার্ট চালু হওয়ার পর থেকে মাসে মাসে সুদের হার বেড়ে চলেছে এবং সর্বশেষ ডিসেম্বরে স্মার্ট সুদের হার দাঁড়িয়েছে ৮.১৪ ভাগ, তাতে করে ব্যাবসায়িক ঋণের সুদের হার ১১.৮৯ শতাংশে পৌঁছাবে। এর ফলে দিনে দিনে ঋণ অনেক দামি হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি পাবে। এসব সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি ঠিক রাখতে গিয়ে মুদ্রানীতি একটু ব্যতিক্রমধর্মী হওয়ার দাবি রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের জুলাইয়ের পর থেকেই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অবস্থানে রয়েছে। সুদের হারও কিছুটা বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। গত অক্টোবরের পর থেকে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা দেওয়া বন্ধ হয়েছে। মানে টাকা ছাপানোটা বন্ধ হয়েছে। এসব পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি না বাড়তে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়। কারণ দেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে আরো বড় দুটি কারণ রয়েছে, যার একটি হচ্ছে ডলার সংকট, অপরটি বাজার ব্যবস্থাপনা।
ডলার-সংকটের ফলে আমদানি, ভোগ্যপণ্যের জোগান ও উত্পাদন ব্যাহত হয়েছে এমন পরিস্থিতি মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতিই এখন বেশি, তা শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে কমানো মোটেই যৌক্তিক নয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে বাজার ব্যবস্থাপনার বড় ভূমিকা থাকে। সময়ে সময়ে দেখা যায়, ১০০ টাকা দামের পণ্যের দাম লাফ দিয়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। একবার বেড়ে গেলে উচ্চপর্যায় থেকে হয়তো পরে কিছুটা কমে আসে; কিন্তু যে পর্যায়ে ছিল, সেই পর্যায়ে আর নামে না। তাই বাজার ব্যবস্থাপনা যদি উন্নত করা না যায়, তাহলে শুধু খুচরা পর্যায়ে মূল্য বেঁধে দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। খুচরা পর্যায়ে যারা আছে, তারা তো বাজার কারসাজির এই খেলার মধ্যে নেই। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে ডলারের সংকট কাটানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে ডলার না আসা এবং হুন্ডি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৫ বিলিয়ন ডলার; কিন্তু ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে এসেছে ৪৩ বিলিয়ন ডলার। বাকি ১২ বিলিয়ন ডলার কোথায় গেল? একইভাবে রেমিট্যািন্সের মাধ্যমে ব্যাংকিং সিস্টেমে যে ডলার আসার কথা, তা-ও আসছে না। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলারের দরের পার্থক্য এত বেশি হয়ে গেছে, মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলেই রেমিট্যান্স বেশি পাঠাতে চাইছে। এখানে পরিবর্তন দরকার হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আর্থিক খাতে ভঙ্গুরতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সাল শেষে আর্থিক খাতে ২৪ শতাংশ সম্পদ ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। এর গোড়ার কারণ খেলাপি ঋণ। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের যথেষ্ট মূলধন নেই। যেগুলো দুর্বল প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচুর অনিয়ম চলছে—সেগুলো যদি একটা শৃঙ্খলার মধ্যে না আনা যায়, তাহলে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা কঠিন হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে কিছু কাজ অবশ্য করা হয়েছে। চলতি বছর অর্থনীতিতে যেসব সংকট রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ২০২৩ সাল থেকে এসেছে। তাই ২০২৪ সালে সরকারের কাছে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ যথা প্রথমত, বাণিজ্য সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা; দ্বিতীয়ত, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করা এবং তৃতীয়ত, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। এগুলোর সমাধানকল্পে সরকারের উত্সাহের কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়।
লেখক: অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ