আজ শনিবার | ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬ | দুপুর ২:০৭

গাজী টায়ারস আগুনে নিখোঁজের স্বজনদের হতাশা

ডান্ডিবার্তা | ০৬ নভেম্বর, ২০২৪ | ৯:৫১ অপরাহ্ণ

ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট:

রূপগঞ্জ উপজেলার গাজী টায়ারস কারখানায় আগুনের ঘটনার দুই মাস পেরিয়েছে। ভয়াবহ আগুনের এই ঘটনায় ১৮২ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান দিতে পারেনি প্রশাসন। এতে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন কাটানো নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২৫ আগস্ট রাতে রূপগঞ্জের রূপসী এলাকায় অবস্থিত প্রাক্তন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন দেশের বৃহৎ টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানাটিতে লুটপাটের ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সারাদিন লুটপাটের পর রাত আনুমানিক সাড়ে দশটার দিকে লুটপাটকারীদের একটি দল ভবনের নিচতলায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেটের সাটারে তালা ঝুলিয়ে চলে যান। ওই সময় অনেকে ভবনটির উপরের অংশে লুটপাটে ব্যস্ত ছিলেন। ভবনটিতে দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত ভবনের প্রতিটি তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। টানা পাঁচদিন পর দমকল বাহিনীর কর্মীরা এই আগুন নেভাতে সক্ষম হন। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক আগুনের সূত্রপাত ও দায়িদের চিহ্নিত করতে ২৭ আগস্ট তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানকে প্রধান করে ৮ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদনটি দাখিল করেছেন কমিটির প্রধান। প্রতিবেদনে এই ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা নয় ‘অগ্নিসংযোগ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও কারা এই কাজ করেছেন তাদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। কমিটি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, গণশুনানি আয়োজন এবং কারিগরী বিশেষজ্ঞদের মতামতের সমন্বয়ে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা ও আগুনের ঘটনার সূত্রপাত নিরূপনে গত ১ সেপ্টেম্বর কারখানার প্রধান ফটকে গণশুনানির আয়োজন করে তদন্ত কমিটি। ওই গণশুনানিতে ৮০ জন নিখোঁজ ব্যক্তি তাদের স্বজনদের তথ্য প্রদান করেন। এছাড়া উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন তালিকা তৈরি করা হয়। তালিকাগুলো একত্রিত করে মোট ১৮২ জন নিখোঁজ ব্যক্তির প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনের তালিকা অনুযায়ী অন্তত ৩০ জন নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের সাথে কথা বলেছে প্রেস নারায়ণগঞ্জ। তাদের নিখোঁজ সদস্যদের কোনো সন্ধান এখনও তারা পাননি বলে জানিয়েছেন। ঘটনার দুই মাস পেরিয়েছে কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ করে সুনির্দিষ্ট করে তাদের কিছু জানানো হয়নি। এমনকি নিখোঁজ ব্যক্তিরা ‘আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন কিনা’ সেই ব্যাপারেও কোনো ঘোষণা এখন পর্যন্ত আসেনি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের অনেকে তাদের প্রিয়জনকে জীবিত পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে আপনজনকে হারিয়ে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে নিজ গ্রামের বাড়িতেও চলে গেছেন। গত ৩০ অক্টোবর নিখোঁজ ব্যক্তিদের অন্তত ১২টি পরিবারের সদস্যরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হকের সাথে দেখা করেন। প্রশাসন ও পুলিশ এই বিষয়ে কাজ করছে বলে তখন জেলা প্রশাসক নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের আশ্বস্ত করেন। ২০ বছর বয়সী ছেলে আমান উল্লাহ’র কোনো খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা বৃদ্ধা রাশিদা বেগম। মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বাবাগো, খালি তো ফোন দিয়া জিগাও। পোলাডার খোঁজ তো দিতে পারলা না। সব হাসপাতালে খুঁজছি, সবহানে খুঁজছি। কোনো খবর পাই না। তোমাগো সরকাররে কও, আমার পোলাডার পোড়া লাশটা দিতে না পারুক, হাড্ডিডা দিতো। আমান রূপগঞ্জের স্থানীয় একটি ব্যাটারি প্রস্তুতকারী কারখানায় কাজ করতেন। তার পরিবারের ভাষ্যমতে, আগুনের ঘটনার রাতে গাজী টায়ারসের কারখানায় আটকা পড়ে ১০টার দিকে বাড়িতে ফোন দিয়েছিলেন আমান। আটকা পড়ার কথা বলতে বলতেই কল কেটে যায়। এরপর তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেনি পরিবার। পরে তার ফোন বন্ধ হয়ে যায়। আমানের খোঁজে কারখানার সামনে ধরনা দেওয়ার পাশাপাশি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি হাসপাতালে গেছেন স্বজনরা। প্রশাসন, শিক্ষার্থী, ফায়ার সার্ভিস; যে যখন নিখোঁজদের তালিকা করেছেন, সবার কাছেই নিজের ছেলের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। সরকারি কোনো সংস্থাই আমানকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। সর্বশেষ গত ৬ অক্টোবর রূপগঞ্জ থানায় নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি করেছেন আমানের বাবা আব্দুল বাতেন। রাশিদা বেগমের মতো একই হাল আমেনা বেগমের। একমাত্র সন্তান অপু মিয়ার (২৬) খোঁজে এখনও গাজী কারখানার সামনে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারেন না। দুই মাস গেলো গা। গাজীর মিলে যাই আর আহি। কেউ ভিতরে ঢুকতে দেয় না। কয়, চুরি করতে গিয়া মরছে, এইটার খবর নাকি কেউ দিবো। এহোন আমার তো পোলা। ওইখানে খাড়াইয়া থাকি ভাল্লাগে। লাশ তো দূরের কথা কাপড়চোপড়ও পাইলাম না। আমার তো আর চাইর-পাঁচটা পোলাপান নাই, একটাই পোলা আছিল আমার। আমি তো মা, আমার কইলজাটা জ্বলতেছে। ঢুকরে কেঁদে ওঠেন আমেনা। কাঁদতে কাঁদতে তার ‘পোড়া কপালের বিত্তান্ত শোনান। স্থানীয় একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ করতো অপু। ঘটনার দিন বেতন তুলেছিল সে। বেতন নিয়ে ফেরার পথে ভিড় দেখে কারখানার ভেতর ঢোকে। তিনি বলেন, ‘এলাকার কয়েকজনরে পাইয়া ভিতরে গেছিল আপু। তারে পাই না দেইখা গাজীর মিলে খুঁজতে পাঠাইছিলাম ছোট ভাইরে (নজরুল)। ভাইগ্নারে খুঁজতে গিয়া আমার ভাইটাও নিখোঁজ। যে আগুন লাগাইলো। হের কপালে যেন আগুনটা লাগে। বরিশালের আব্দুস সালাম রূপগঞ্জের একটি টেক্সটাইল কারখানায় চাকরি করতেন। স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন ভাড়াবাসায়। আগুনের ঘটনায় নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে সালামের নাম। তাঁর খোঁজে গ্রাম থেকে ছুটে এসেছিলেন ছোটভাই মো. শামীম। দুইদিন রূপগঞ্জে থাকার পরও যখন কোনো খোঁজ পেলেন না তখন আবার গ্রামে ফিরে যান। এলাকার পরিচিত একজনের সাথে ওই কারখানায় ঢুকছিল। কারখানা, আশেপাশের এলাকা, হাসপাতাল; সব জায়গায় খুঁজছি। কোনো সন্ধান পাই নাই। মনে সান্তনা দেই এই বইলা যে, হয়তো সে অন্য কোনো ঝামেলায় পড়ছে। হয়তো সুস্থ শরীরে একদিন বাড়িতে আসবো বলেন শামীম। তবে, আশা নেই জাকির হোসেনের। তার ছোটভাই মনির হোসেন (২৮) মারা গেছেন ধরে নিয়ে সুনামগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে গায়েবানা জানাজাও হয়েছে বলে জানান তিনি। গ্রামে ফেরার আগে ভবনটিতে ঢুকে মনিরের জুতা জোড়া খুঁজে পেয়েছিলেন জাকির। ওই জুতা আর ভবন থেকে একমুঠো ছাই নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। অনিশ্চয়তার সাথে দিন পার করছেন রাজমিস্ত্রি আলী হোসেন (২৪), তরুণ আজাদ হোসেন (২১), মোহাম্মদ আলী (৩৭), টেক্সটাইল কারখানা শ্রমিক মো. আরিফ (২৮), স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপের শ্রমিক আলী আসাদ ভূঁইয়া (৪৩), গাড়িচালক আবু সাইদ ভূঁইয়া (৪৮), মাছ বিক্রেতা আব্দুল জলিল মিয়া (৩৮), চাকরিজীবী জহিরুল ইসলাম (৪২), ১৩ বছরের কিশোর নিরবের পরিবার। ক্ষোভ প্রকাশ করে আলী হোসেনের ছোটভাই মো. শাকিল বলেন, “প্রশাসনের কাছে যাইয়া কোনো লাভ নাই। তারা কিছু করতেছে না। এইটা তো সাধারণ কোনো ঘটনা না। নিখোঁজের সংখ্যা তো অনেক। প্রশাসন আর সরকার চাইতেছে এই ব্যাপারটাতে ধামাচাপা দিতে। নাইলে এতদিন হয়ে গেলো, তারা কোনো খোঁজ দিবো না?” প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে দশটি সুপারিশ করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবনটি অপসারণের মাধ্যমে উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করা, হাড়গুলোর যথাযথ প্রক্রিয়া শনাক্ত করা এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা অধিকতর যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাকে নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।  যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হওয়াতে সেখানে পুরোপুরিভাবে উদ্ধার অভিযান চালানো যায়নি। তবে, যে ১৮২টি পরিবার তাদের স্বজনদের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে দাবি করছেন তাদের ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জেলা পুলিশকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। এছাড়া, উদ্ধার হওয়া হাড়গুলোও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মাধ্যমে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।’ভবনটিকে ভেঙে উদ্ধার অভিযান চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়াতে সেটি বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। ভবনটি ভাঙা হলে ভেতরে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। তবে, ভবনটি ভাঙার কাজ করবে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো সহযোগিতা লাগলে করবো। কিন্তু ভবনটি তারা কবে ভাঙবেন এই বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কোনো সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি।’যদিও কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভবনটি ভাঙার বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি তারা পাননি। এদিকে, গাজী টায়ারসে ৫ থেকে ৮ আগস্ট হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তিনটি এবং পরে ২৫ আগস্ট হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আরও দু’টি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রূপগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, ‘মামলাগুলো কারখানা কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে দায়ের করেছেন। কারা এই হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত ছিলেন তাদের চিহ্নিত করতে পুলিশ কাজ করছে।’




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
নামাজের সময়
সেহরির শেষ সময় - ভোর ৪:৫৭
ইফতার শুরু - সন্ধ্যা ১৭:১৫
  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৫:০২
  • ১১:৪৭
  • ১৫:৩৬
  • ১৭:১৫
  • ১৮:৩১
  • ৬:১৬
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা