আজ বুধবার | ২২ জানুয়ারি ২০২৫ | ৮ মাঘ ১৪৩১ | ২১ রজব ১৪৪৬ | রাত ৩:১৪

হাসিনার পতন নিয়েই কি খুশি থাকতে হবে?

ডান্ডিবার্তা | ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ | ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ

এ কে এম জাকারিয়া
সংস্কার, নির্বাচন এবং এটা নিয়ে দেশের রাজনীতি—সবকিছুই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। হাসিনার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থী-সমাজ, এর সহায়ক ও সমর্থক রাজনৈতিক শক্তি এবং অন্তর্বতী সরকার—কেউই এখন আর একসুতায় গাঁথা মালার মধ্যে নেই। শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র ও সমাজে বড় ধরনের সংস্কার চান। তাঁরা মনে করেন, শুধু একটি নতুন নির্বাচন আয়োজনের জন্য এতগুলো মানুষ প্রাণ দেননি। তাঁরা এমন একটি রাষ্ট্রকাঠামো নিশ্চিত করতে চান, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ হাসিনার মতো স্বৈরশাসক হয়ে উঠতে না পারেন। সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারসহ কিছু সংস্কার এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের আগেই তাঁরা এসব বিষয়ে নিশ্চিত হতে চান। বর্তমান সংবিধানের অধীনে নতুন সংসদ তৈরি হলে তারা সংবিধান সংস্কার বা নতুন সংবিধান তৈরি করবে—এমন ধারণার প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থা নেই। অনেক রক্তের বিনিময়ে হাসিনার মতো একজন স্বৈরশাসকের উৎখাতকে প্রচলিত অর্থে বিপ্লব বলার সুযোগ নেই (যদিও অনেকে মনে করেন, ৫ আগস্ট বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল)। কিন্তু এটা আবার গতানুগতিক অভ্যুত্থানও নয়। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান আর জুলাই অভ্যুত্থান এক নয়। নব্বইয়ে এত মানুষ প্রাণ দেননি, এত মানুষ রাস্তায়ও নামেননি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কিছু বিপ্লবী চেতনা ও অবস্থান আছে। এই গণ-অভ্যুত্থান থেকে ছাত্র ও জনতার অনেক চাওয়া তৈরি হয়েছে। নতুন একটি নির্বাচন এবং এর মধ্য দিয়ে সেই পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার এটি ভয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন আছে, তেমনি অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া জনতার মধ্যেও আছে। গণ-অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে যাচ্ছে—এমন হতাশাও অনেকে পেয়ে বসেছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ গণ-অভ্যুত্থানের সহায়ক কিছু রাজনৈতিক দলের অবস্থান আবার এ ক্ষেত্রে ভিন্ন। তারা দ্রæত নির্বাচন চায়, নির্বাচনের রূপরেখা চায়। তারা মনে করে, সংস্কার বা যা কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন, তা করবে নির্বাচিত সরকার। দ্রæত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা সরকারকে নানাভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে গত ১৬ ডিসেম্বরের ভাষণে নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ের ঘোষণা দেন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর সরকার সংস্কারের জন্য বেশ কিছু কমিশন করেছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই সম্ভবত তাঁর ও তাঁর সরকারের চাওয়া ছিল। কিন্তু তাঁর বিজয় দিবসের ভাষণে স্পষ্ট হলো যে তিনি সেই অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমি সব প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদের যদি, আবার বলছি “যদি”, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’ বোঝা যায়, বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের সময় ও রূপরেখা ঘোষণার দাবির প্রতি সাড়া দিয়েই তিনি নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার কথা বলেছেন। আমাদের মনে আছে, এর আগে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ চার বছর করার কথা ভাবা হচ্ছে এবং কোনো অন্তর্র্বতী সরকারের মেয়াদই নির্বাচিত সরকারের বেশি হওয়া উচিত নয়। তখন এটা ধরে নেওয়ার সুযোগ ছিল যে অন্তর্র্বতী সরকারের মেয়াদ তিন থেকে সাড়ে তিন বছরও হতে পারে। ১৬ ডিসেম্বর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের যে সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করেছেন, সেখানে অস্পষ্টতার কিছু নেই। তিনি স্পষ্ট করে এ বছরের শেষ থেকে আগামী (২০২৬) বছরের মাঝামাঝির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ঐক্য কাউন্সিল গঠনেরও ঘোষণা দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ তৈরির পথরেখা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসের এই ভাষণ বিএনপিকে খুশি করতে পারেনি। বরং দলটি বৈঠক করে তাদের হতাশার কথা বলেছে। নির্বাচন নিয়ে যে সময়ের কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা, বিএনপি তাকে যৌক্তিক মনে করেনি। সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের পথে এগোলে পুরোনো ধারায় ফিরে আসার যে আশঙ্কা ছাত্রদের মধ্যে রয়েছে, তা উপেক্ষা করা যায় না। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে। চাঁদাবাজির হাতবদল, দখল ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ঘটনা তো দেশজুড়ে ঘটছে। আবার ছাত্রদের দল গঠনের প্রক্রিয়া, সেখানে গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকারে ভূমিকা, তাদের অর্থের উৎস—এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা না থাকলে বিএনপির উদ্বেগও কাটবে না। বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে রোডম্যাপ দেবেন। সেটা তিনি দেননি। এটা আমাদের কিছুটা হতাশ করেছে এবং একই সঙ্গে জাতিকেও কিছুটা হতাশ করেছে।’
বিএনপির এই হতাশা কেন? বোঝা যায়, বিএনপির মনে নানা শঙ্কা রয়েছে। তারা এ ঘোষণার ওপর পুরো আস্থা রাখতে পারছে না। বিএনপি একটি পুরোনো রাজনৈতিক দল, তারা অমূলক কোনো আশঙ্কায় করছে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। নিশ্চয়ই বিএনপির দুশ্চিন্তার যৌক্তিক কোনো কারণ রয়েছে। বিএনপির নেতাদের মুখে গত কয়েক মাসে মাইনাস তত্ত¡, বিরাজনীতিকরণ—এসব কথা শোনা গেছে। এই তো সেদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, মাইনাস টুর আশা জীবনেও পূরণ হবে না। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম কাজ হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন হচ্ছে প্রথম সংস্কার। তিনি বলেছেন, ‘এখানে মাইনাস টুর কথা যারা বলে, এটা তাদের উইশফুল থিঙ্কিং। ওই আশা জীবনেও পূরণ হবে না। ওটা এরশাদ পারেননি, এক-এগারোতে পারেনি। আর এখন তো বিএনপি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী দল। একে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না।’ বিরাজনীতিকরণ বা রাজনীতির ‘মাইনাস’ তত্ত¡ নিয়ে যে বিএনপির মধ্যে শঙ্কা রয়েছে তা স্পষ্ট। এমনকি তারা এটাও মনে করে যে তাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য কোনো মহল তৎপর রয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগী কিছু দল এখন রাজনীতির মাঠে নেই। বিএনপিই এখন দেশে সক্রিয় সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। জামায়াতের সঙ্গে দলটির দূরত্ব তৈরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক মিত্রও জুটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়েও বিএনপি কিসের ভয়ে ভীত? কারা এত বড় ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ যে বিএনপির মতো দলকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে? গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছেন। বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত হয়েছে তাঁদের ইচ্ছায়। সরকারে তাঁদের অংশীদারত্বও রয়েছে। আবার তাঁরা নানা ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করেন, সরকারের ওপর চাপ দেন। ছাত্রদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কটি অস্পষ্ট। কিন্তু ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনকে অনেকে ‘কিংস পার্টি’ তৈরির চেষ্টা হিসেবে দেখছে। দল গঠনের প্রক্রিয়ায় গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে। অর্থের উৎস নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সম্ভবত এসবই বিএনপির দুশ্চিন্তার কারণ। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজ ও গণ-অভ্যুত্থান সংগঠনের সহায়ক অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধ ও সন্দেহ-অবিশ্বাস দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলেছে। দুই পক্ষের মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে।
সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের পথে এগোলে পুরোনো ধারায় ফিরে আসার যে আশঙ্কা ছাত্রদের মধ্যে রয়েছে, তা উপেক্ষা করা যায় না। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে। চাঁদাবাজির হাতবদল, দখল ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ঘটনা তো দেশজুড়ে এরই মধ্যে ঘটতে শুরু করেছে। আবার ছাত্রদের দল গঠনের প্রক্রিয়া, সেখানে গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকারে ভূমিকা, তাদের অর্থের উৎস—এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা না থাকলে বিএনপির উদ্বেগও কাটবে না। গণ-অভ্যুত্থান শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছে, এটা অবশ্যই বড় পাওয়া, কিন্তু এটাই যেন একমাত্র প্রাপ্তি না হয়। গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থী সমাজ ও সহায়ক রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐক্য ধরে রাখতে না পারে তবে শেষ পর্যন্ত শুধু হাসিনার পতন নিয়েই খুশি থাকতে হবে। গণ-অভ্যুত্থান ছাত্র–জনতার মধ্যে নতুন রাষ্ট্র গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, তা অধরাই থেকে যাবে।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা