মারুফ মল্লিক
গত শতকের সত্তর বা আশির দশক। মার্কিন-সোভিয়েত লড়াই তুঙ্গে। বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশকে নিজ বলয়ে আনার প্রতিযোগিতা চরম অবস্থায়। এখানে গৃহযুদ্ধ তো ওখানে সামরিক অভ্যুত্থানে সরকার বদলে যাচ্ছে। ওই সময় বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ কর্তৃত্ববাদী শাসকদের অধীনে ছিল। একদিকে সোভিয়েত–সমর্থিত জাতীয়তাবাদের নামে কঠোর নিষ্পেষণমূলক একদলীয় শাসন; অপর দিকে মার্কিন মদদে অভ্যুত্থান, গৃহযুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয়। ঠিক এই সময় দেশের ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালে তিনি ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের অংশ ছিলেন না বা উল্লেখযোগ্য কোনো চরিত্রও নন। কিন্তু ৭ নভেম্বর তিনিই আসল নায়ক। সিপাহী জনতার বিপুল সমর্থন ওসময় তাঁকে নায়কের আসনে বসিয়ে দিয়েছে। এর আগে তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধেরও অন্যতম নায়ক ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বাকশালের একদলীয় শাসনের পতনের পরপরই জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। অর্থনীতির অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এমনই একসময়ে জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মঞ্চে চলে আসেন। ওই পরিবর্তনের বিপক্ষ শক্তিও ছিল। এর প্রভাব জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পরিলক্ষিত হয়। সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না হলেও কমবেশি ২৪ থেকে ২৫টি ছোট–বড় সামরিক অভ্যুত্থান জিয়াউর রহমানকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। সর্বশেষ এক ঘটনায় তিনি সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যদের হাতে নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধের জেড ফোর্সের অধিনায়ক ও সেক্টর কমান্ডার সামরিক কর্মকর্তা থেকে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় শাসকে পরিণত হওয়া জিয়াউর রহমানের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী ছিল গতকাল রোববার। খুব দ্রæতই তিনি দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। এর মূল কারণ হচ্ছে, তিনি রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজজীবন সবর্ত্রই তিনি উদারনীতির প্রচলন করেছিলেন। সেই সময়ের অনেক শাসকই কর্তৃত্ববাদের রাজনীতির ভাবনা থেকে বের হতে পারেননি। শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জিয়াউর রহমানের সামনে দুটি বিকল্প ছিল। এক, বাকশালের ধারাবাহিতা রক্ষা করে ওই সময়ের তৃতীয় বিশ্বের অনেক শাসকের মতো কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠ করা; দুই, জনগণের কাছে যাওয়া। জিয়া দ্বিতীয় পথ অনুসরণ করে উদারপন্থী রাজনীতি নিয়ে জনগণের কাছে গেলেন। তিনি সব মত ও পথের দল নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্নিমাণে অগ্রসর হন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকেও তিনি মধ্যপন্থী উদার দল হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপির নীতি–আদর্শ বিবেচনা করলে দেখা যাবে, জিয়াউর রহমান ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের রাজনীতির দর্শন এখানে প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি বাকশালের একদলীয় শাসনের পরিবর্তে ফিরিয়ে আনেন বহুদলীয় গণতন্ত্র। এমনকি বাকশালে বিলুপ্ত হওয়া আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন। পাশাপাশি অন্যান্য দলকেও রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন। সমালোচকেরা অভিযোগ করেন, তিনি জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন; কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি একই সঙ্গে বিলুপ্ত আওয়ামী লীগকেও বাকশালের গহŸর থেকে তুলে এনেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের খেতাব কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু দেশের পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এখন পলাতক। আর চরম দমন, নির্যাতনের মুখেও জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দল টিকে গেল হিমালয়সমান বাধাকে মোকিবেলা করে। এর কারণ, জিয়াউর রহমানের নীতি ও উদারপন্থী রাজনৈতিক দর্শন। কে রাজনীতি করতে পারবে বা কে করতে পারবে না, সেই সিদ্ধান্ত জিয়াউর রহমান জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বরং প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে মোকাবিলা করার পথ বেছে নিয়েছিলেন। বহুপক্ষীয়, উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজগঠনের জন্য ১৯ দফা ঘোষণা করে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে জনসাধারণকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টায় তিনি সফল হয়েছিলেন। প্রথমত, জিয়াউর রহমান সব জাতি–ধর্ম–বর্ণের সমান পরিচয় ও অধিকারের ভিত্তিতে একটি সমাজগঠনে উদ্যোগী হন। তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রচার করেন রাষ্ট্রের নাগরিকদের একক রাজনৈতিক পরিচয় নির্মাণের জন্য। সংকীর্ণ জাতিবাদী বাঙালি বা ধর্মীয় জাতিয়তাবাদের ধারণা থেকে বের হয়ে এসেছিলেন তিনি। মূলত পশ্চিম বা উত্তর ইউরোপের দেশগুলোর আদলে রাষ্ট্রের ভিত্তিতে তিনি নাগরিকদের পরিচয় নির্মাণের প্রয়াসী হন। উল্লেখ্য যে জিয়াউর রহমান ওই সময় এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকায় প্রবল জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের ঢেউ থেকে নিজের রাজনৈতিক দর্শনকে আলাদা করতে পেরেছিলেন। উত্তর ঔপনিবেশিক সময়ে দেশগুলো তখন জাতিবাদীতায় আচ্ছন্ন ছিল। তারা মনে করত, জাতিবাদী জাতীয়তাবাদই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সম্ভাব্য দর্শন। কিন্তু জাতিবাদী ধারণা সমাজে, রাষ্ট্রে বিভাজন সৃষ্টি করে। ইউরোপ তখন এই ধারণা থেকে বের হয়ে এলেও এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিনের দেশগুলোর তখনো এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। এমন অবস্থায় যুদ্ধবিধ্বস্ত, অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির একটা দেশের শাসক হিসেবে জিয়াউর রহমানের পক্ষে খুব একটা সহজ বিষয় ছিল না জাতিবাদী কর্তৃত্বের ধারণা থেকে বের হয়ে পশ্চিম ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের আদলে একটি দল গঠন করা এবং রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। রাজনৈতিক দর্শনকে জিয়াউর রহমান অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মাধ্যম প্রয়োগ করেন। তিনি গ্রহণ করেছিলেন রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজির বিকাশের ধারণাকে। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিকাশে নীতি ও কৌশল প্রয়োগ করেন। তাঁর সময়ই বেসরকারি খাতে শিল্পকলকারখানার পাশাপাশি এনজিওগুলোর বিস্তার ঘটতে থাকে। সামাজিক উন্নয়নে এনজিওগুলো ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে এই এনজিওগুলোই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারী উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সারা দেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ জিয়াউর রহমান ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদানপ্রথা তাঁর আমলেই শুরু হয়। কিন্তু এরপরও বিএনপি কি মধ্যডান না ডানপন্থী দল, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পারলে বিএনপিকে ইসলামপন্থী দল হিসেবেই পরিচয় দেয়। কিন্তু আমরা যদি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন বিশ্লেষণ করি, বিশেষ করে তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ আমলে নিই, তাহলে বিএনপিকে একটি উদার মধ্যবাম ধারার দল হিসেবেই উল্লেখ করতে হয়। বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে ইউরোপীয় মধ্যবাম ধারার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট বা লেবার পার্টির সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। তবে ভোটের রাজনীতিতে ধর্মপন্থী দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করায় বিএনপির উদার পরিচয় অনেকটা আড়ালে চলে গিয়েছিল। মধ্যবাম ধারার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট রাজনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে রাজনৈতিক উদারতা, মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, কেইনজিয়ান অর্থনৈতিক নীতি, সম্পদের সুষম বণ্টনের নিশ্চয়তা ও কল্যাণমূলক ব্যবস্থা। জিয়াউর রহমান দেশে একটি বহুদলীয় উদার রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তিনি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ রেখেছিলেন। অর্থনীতিকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেননি। পাশাপাশি তিনি শহর ও গ্রামের ব্যবধান কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কৃষির উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি সমন্বিত যৌথ খামার পদ্ধতিরও পরিকল্পনা করেছিলেন। সব মিলিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে জিয়াউর রহমান একটি উদার, বহুপক্ষীয়, সামাজিক উন্নয়ন রাজনীতির সূচনা করেছিলেন। কর্তৃত্ববাদের স্রোতে গা না ভাসিয়ে সময়ের চেয়ে জিয়াউর রহমানের ভিন্নতর এই অবস্থান দেশের রাজনীতিতে তাঁকে বিশেষ স্থান দিয়েছে। কোনো শাসকের মতো জিয়াউর রহমানেরও সমালোচনা আছে। তবে রাজনৈতিক দর্শনের জায়গা থেকে বিবেচনা করলে তিনি সমসাময়িক আশপাশের অন্যান্য শাসকের তুলনায় ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁকে নিয়ে অপপ্রচার, নিন্দামন্দ আওয়ামী লীগ কমে করেনি। তাঁর নাম–নিশানা মুছে দিতে চেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের খেতাব কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু দেশের পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এখন পলাতক। আর চরম দমন, নির্যাতনের মুখেও জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দল টিকে গেল হিমালয়সমান বাধাকে মোকিবেলা করে। এর কারণ, জিয়াউর রহমানের নীতি ও উদারপন্থী রাজনৈতিক দর্শন।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
হাবিবুর রহমান বাদল ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের সাথে সাথে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার দোসররা কেউবা পালিয়েছে আবার কেউ আত্মগোপনে রয়েছে। বিগত পতিত সরকারের আমলে পেশাদার সাংবাদিকরা সব কিছু দেখলেও কোন কিছুই লিখতে পারতনা। আকাঁরে ইঙ্গিতে কোন কিছু লিখলেই সেইসব সাংবাদিকের উপর খর্গ নেমে […]
হাবিবুর রহমান বাদল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের অকল্পনীয় পতন ঘটে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগের দিনও ভাবেনি তার সরকারের শুধু পতনই ঘটবে না, বরং তাকে চুপিসারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। আওয়ামীলীগের পতন ও শেখ হাসিনার পলায়নের পর পরই আওয়ামীলীগের তৃনমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও আত্মগোপনে চলে যায়। এর […]
ডান্ডিবার্তা রিপোর্ট: আড়াইহাজার থানায় দায়ের করা উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি বাবুল মিয়া হত্যা মামলা নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। গত ৩ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাবুল মিয়ার মৃত্যু হলেও দুই মাস পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি নিহত হয়েছেন উল্লেখ করে ২২ আগস্ট হত্যা মামলা করেছেন দুপ্তারা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন। এই […]
প্রকাশক ও সম্পাদক
হাবিবুর রহমান বাদল
০১৯১১০১০৪৯০
hr.badal@yahoo.com
বার্তা ও বাণিজ্যক কার্যালয়
৬. সনাতন পাল লেন
(হোসিয়ারী ক্লাব ভবন, তৃতীয় তলা)
৭৬৪২১২১
dbartanews@gmail.com
রেজি: ডিএ নং-২০৯৯