আজ বৃহস্পতিবার | ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৬ মাঘ ১৪৩১ | ২৯ রজব ১৪৪৬ | সকাল ১০:৩৯

সরকার কি আমলাতন্ত্রের ফাঁদে!

ডান্ডিবার্তা | ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৮:৫৩ পূর্বাহ্ণ

মনোজ দে
প্রায় ২৫০ বছর আগে কলকাতার ডালহৌসিতে রাইটার্স বিল্ডিং গড়ে উঠেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক ও করণিক কাজ করার জন্য ইংল্যান্ড থেকে আসা ক্লার্ক বা কেরানিদের থাকার জায়গা ছিল সেটা। রাইটার্স বিল্ডিংই হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের প্রশাসনিক কাজের জায়গা। সে কারণে এটিকে পরবর্তী সময়ে মহাকরণ বলা হতো। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেখানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সচিবালয় ছিল। যাহোক, রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সেই কেরানিরাই আজকের আমলাতন্ত্রের আদি মানুষ। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসা ব্রিটিশদের ১৯০ বছরের প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের মূল ভিত্তিই ছিল আমলাতন্ত্র। ঔপনিবেশিক এই প্রায় ১০০ বছর তাদের আমলাতন্ত্রে এদেশীয় কাউকে জায়গা দেওয়া হয়নি। ১৮৩৫ সালে মেকলে তাঁর শিক্ষানীতিতে এমন একটা মধ্যশ্রেণি তৈরির পরিকল্পনা করেন, যারা শাসক ও শাসিতের মধ্যে কাজ করবে দোভাষীর, রং ও রক্তের পরিচয়ে হবে এদেশীয়; কিন্তু রুচি, মতামত, নীতিজ্ঞান ও বুদ্ধিতে হবে ইংরেজ। মেকলের এই শিক্ষানীতির তিন দশক পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এদেশীয়দের মধ্যে প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রে নিয়োগ পান। তিনি ডেপুটির সঙ্গে ‘বিড়ালের’ তুলনা দিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু মনমোহন সিংয়ের আমলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০২১ সাল তাঁর স্মৃতিচারণামূলক ‘পলিসিমেকারস জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি’ বইয়ে লিখেছেন, ভারতীয় আমলারা মিনিটে ১৬ বার ‘স্যার’ ডাকেন। আমলাতন্ত্রে লালফিতার দৌরাত্ম্য নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এসব ঔপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকে পাওয়া অভ্যাস। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাকরিতে থাকা আমলারা এসব পছন্দ করেন। তাই সময় বদলালেও এমন আচরণ ও প্রথা বদলায়নি।’ অন্তর্বতী সরকারের এখন এই উত্তর খোঁজা জরুরি, তারা কেন ছাত্র–জনতার শক্তির ওপর ভরসা না করে আমলাতন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়েছে? শুধু কয়েকজন আমলাকে সরিয়ে দেওয়ার মানে কিন্তু আমলাতান্ত্রিকতার অবসান নয় ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার কারণ হলো, ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্র্বতী সরকারের আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠেছে। ২০ জানুয়ারি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘অন্তর্র্বতী সরকার প্রথম থেকেই একটা স্ববিরোধিতার মধ্যে ঢুকে গেছে, সেটা নিজেদের আরোপিত স্ববিরোধিতা। সরকারের ভুলটা হলো প্রথম থেকেই আমলাতন্ত্রকে চালকের আসনে বসিয়ে রেখেছে। একদিকে বলা হচ্ছে বৃহত্তর পরিবর্তনের কথা, অথচ চালকের আসনে বসানো হয়েছে তাঁদেরই, যাঁদের পরিবর্তন করা এই অভ্যুত্থানের অন্যতম এজেন্ডা।’ স¤প্রতি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সিম্পোজিয়ামে রওনক জাহান, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও আনু মুহাম্মদও আমলাতন্ত্রের ওপর অন্তর্র্বতী সরকারের নির্ভরতার নীতির কঠোর সমালোচনা করেন। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের শক্তিশালী চক্র ভাঙতে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে প্রশ্ন তোলেন। আমলাতন্ত্রকে কৃষ্ণগহŸরের সঙ্গে তুলনা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও সর্বজনকথা সম্পাদক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আমলাতন্ত্রে পরিবর্তন না হলে বাকি আর পরিবর্তন সম্ভব নয়। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমলারা এখনো গগনবিদারী ভূমিকা পালন করছে। তারা এখনো ক্ষমতাবান।’ জনপ্রশাসন সংস্কারের জন্য গঠিত সংস্কার কমিশন গত মাসের প্রথম দিকে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের সুপারিশের কিছু বিষয় সামনে আনলে আমলারা যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানান, সেটা ছিল দৃষ্টিকটু। চাকরিবিধি সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে নজিরবিহীনভাবে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। এমনকি এই হুমকিও দেওয়া হয়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানকে না সরালে কীভাবে তাঁকে অপসারণ করতে হবে, সেই কোর্স তাঁদের জানা আছে। আমলাদের এই আচরণ নিয়ে তথ্য ও স¤প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘খুব সা¤প্রতিক সময়ে আমরা আমলাদের বক্তব্যে শুনতে পাচ্ছি যে তাঁরা একধরনের হুমকি দিচ্ছেন। এটার একটা সাহস পেয়েছেন বিগত সময়গুলোতে।’ ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আমলেও (বেসামরিক ও সামরিক শাসন) প্রতিটি সরকারই আমলাতন্ত্রকে কমবেশি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগের আমলে সেটা সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছিল। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন ধীরে ধীরে সর্বব্যাপী স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে রূপ পেয়েছিল, তাতে আমলাতন্ত্রেরও বড় অবদান ছিল। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র মিলে গোষ্ঠীতন্ত্র তৈরি হয়েছিল। সবাই মিলেমিশে তৈরি করেছিল অর্থনীতির চোরতন্ত্র। প্রতিবছর বাজেটে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় প্রজাতন্ত্রের ১৪ লাখ কর্মচারীর বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য খরচ জোগাতে। এই ব্যয়ে কতটা ন্যায্যতা আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা, সরকারি কর্মচারীদের সবচেয়ে ওপরের স্তর আর সবচেয়ে নিচের স্তরের মধ্যে বেতন-ভাতার পার্থক্য আকাশ-পাতাল। নিচের দিকে শুরুতে এমন বেতন দেওয়া হয়, যেটা অবাস্তব। নিছক ডাল দিয়ে ভাত খেয়েও কি মাসকাবারি মাইনে দিয়ে কারো সংসার চলা সম্ভব? জনপ্রশাসনে বাজেট এত বেশি হওয়ার একটা বড় কারণ হলো বিশাল একটা মাথাভারী আমলাতন্ত্রকে পুষতে হয় সরকারকে। আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে নিচু স্তরে থাকা একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বাংলোবাড়ি, দামি গাড়িসহ যেসব সুযোগ–সুবিধা পান, যে অপরিসীম ক্ষমতা তিনি ভোগ করেন, সেটা কি সাধারণ নাগরিক, এমনকি মর্যাদায় তাঁর সমান অন্য পেশার লোকদের থেকে তাঁকে আলাদা করে তোলে না? ঔপনিবেশিক আমলে আমলারা ছিলেন কার্যত শাসক। সেই ঐতিহ্য থেকে আমরা কি বের হতে পেরেছি? প্রশাসনের যত ওপরের স্তরে যাওয়া যাবে, ততই রাষ্ট্রীয় সুযোগ–সুবিধা ও ক্ষমতা বাড়ে; সেই সঙ্গে বাড়ে কর্তৃত্ব। একজন জেলা প্রশাসক জেলার অন্তত ১৪৬টি কমিটির প্রধান। কোনো প্রকল্পের অর্থই তাঁদের ছাড়া ছাড় হয় না। সরকারি প্রকল্পই বর্তমান আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব ও দুর্নীতির প্রাণভোমরা। অবসরের পরেও তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে রাষ্ট্রের লোভনীয় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগগুলো। হাসিনা সরকারের শেষ দিকে ডিসিরা তাঁদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছিলেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সা¤প্রতিক বছরগুলোয় আমলা-শিক্ষকের অতি–উৎপাদনও আমরা দেখতে পাই। স¤প্রতি অন্তর্বতী সরকার এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেগুলো আগের সরকারের ধারাবাহিকতা বললেও অত্যুক্তি হবে না। এসব সিদ্ধান্ত ও কাজের ধরনের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের প্রভাব সুস্পষ্ট। এর মধ্যে রাজস্ব বাড়াতে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানো, সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে জড়ালে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে মাউশির নির্দেশনা—এ দুটি বিষয়ে জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। সমালোচনার মুখে সরকার ভ্যাটের ক্ষেত্রে কিছুটা পিছু হটে, মাউশির ক্ষেত্রে পুরোপুরি সরে আসে। আইএমএফের চাপে জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ানোর চিন্তাও করছে সরকার। একজন উপদেষ্টাকে আমরা দেখেছি শীতবস্ত্র বিতরণের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা তৈরি হয়েছে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে হতাহত মানুষের তালিকা তৈরি ও সরকারঘোষিত সহযোগিতা দেওয়ার ক্ষেত্রে। সাড়ে পাঁচ মাস পরও সেই তালিকা চূড়ান্ত করা যায়নি, ভুক্তভোগীদের অনেকে সহযোগিতা পাননি। কিন্তু এর বিপরীতে আমলাতন্ত্রের পদবঞ্চিতদের তালিকা তৈরি হয়ে গেছে। তাঁদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিও হয়ে গেছে। অর্থের সংস্থানে সরকারকে যখন হন্যে হয়ে ঘুরতে হচ্ছে, তখন সরকারি চাকরিজীবীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার কথাও তারা ভাবছে। অথচ দেশে বিভিন্ন কাজ ও পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা সাত কোটির বেশি। তাঁদের জীবনমান উন্নতির কথা কে ভাববে? ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য এক ঘটনা। অভ্যুত্থান নিজেই সবচেয়ে বড় ম্যান্ডেট। ফলে সব অচলায়তন ভেঙে নতুন করে তৈরির এক সুযোগ এনে দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শক্তিগুলো ও নাগরিকের সৃজনশীলতার ওপর নির্ভর করতে পারাটা ছিল সরকারের জন্য সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য। কিন্তু রাজনীতিতে মোমেন্টাম ধরতে পারাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্তর্র্বতী সরকারের এখন এই উত্তর খোঁজা জরুরি, তারা কেন ছাত্র–জনতার শক্তির ওপর ভরসা না করে আমলাতন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়েছে? শুধু কয়েকজন আমলাকে সরিয়ে দেওয়ার মানে কিন্তু আমলাতান্ত্রিকতার অবসান নয়।




Your email address will not be published.

Comments are closed.


আজকের পত্রিকা
আজকের পত্রিকা
ফেসবুকে আমরা
পুরনো সংখ্যা
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
Copyright © Dundeebarta 2024
ডান্ডিবার্তা